পৃথিবীতে শুধু নবী-রাসুল (আ.) আল্লাহর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ লাভ করেছেন। আল্লাহর সঙ্গে তাঁদের কথোপকথন কখনো হয়েছে সরাসরি আবার কখনো হয়েছে ফেরেশতা ও ওহির মাধ্যমে। সেসব কথোপকথনে উঠে এসেছে আল্লাহর প্রতি তাঁদের সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও শিষ্টাচার। যা বিশ্বাসী মানুষের জন্য অনুসরণীয়।
আল্লাহর প্রতি শিষ্টাচারের অর্থ
শায়খ খালিদ ইবনে জুমআ আল্লাহর প্রতি বান্দার শিষ্টাচারের স্বরূপ তুলে ধরে বলেছেন, ‘আল্লাহর প্রতি শিষ্টাচার প্রদর্শনের অর্থ হলো, প্রত্যেক আচরণ আল্লাহর মর্যাদা ও প্রভাব-প্রতিপত্তির অনুকূল করার মাধ্যমে তাঁর প্রতি সর্বোচ্চ আনুগত্য প্রদর্শন। অন্তরে আল্লাহর মর্যাদার বিপরীত আচরণ প্রকাশের ভয় ও লজ্জা ধারণ করা। আর তা প্রকাশ পাবে অন্তর, জিহ্বা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সব কিছুতেই।’ (মাওসুআতুল আখলাক, পৃষ্ঠা-১২১)
আল্লাহর প্রতি শিষ্টাচারের তিন দিক
আল্লাহর প্রতি বান্দার শিষ্টাচার প্রকাশের দিক তিনটি। তা হলো—এক. অন্তরে ধারণ, দুই. মুখে স্বীকার, তিন. কাজে প্রকাশ।
অন্তরের শিষ্টাচার : অন্তরের শিষ্টাচারই মূল—যার ওপর প্রতিষ্ঠিত অন্য দুটির ভিত। তা হলো, একান্তই আল্লাহকে ভালোবাসা ও ভয় পাওয়া, তাঁর প্রতি আশা রাখা, তাঁর ওপর ভরসা করা, তাঁর কাছেই সাহায্য চাওয়া। অন্তর গাইরুল্লাহ তথা অন্য যেকোনো কিছু থেকে মুক্ত করা। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যদি তারা বিমুখ হয়, তবে বলুন! আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। যিনি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই। তাঁর ওপরই আমি ভরসা রাখি, তিনি মহা আরশের মালিক।’ (সুরা তাওবা, আয়াত : ১২৯)
জবানের শিষ্টাচার : আল্লাহর প্রতি জবানের শিষ্টাচার হলো, এমন কথা পরিহার করা যাতে আল্লাহর সম্মান ও মর্যাদা প্রকাশ পায় না, এমন কথা না বলা যাতে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্য থাকে না। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা! আল্লাহকে ভয় করো এবং সঠিক কথা বলো।’ (সুরা আহজাব, আয়াত : ৭০)
কাজকর্মে শিষ্টাচার : কাজে-কর্মে আল্লাহর প্রতি শিষ্টাচার রক্ষার অর্থ আল্লাহর অবাধ্য না হওয়া এবং আল্লাহ প্রদত্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাপ কাজে ব্যবহার না করা। আচার-আচরণে এমন কিছু প্রকাশ না পাওয়া, যা আল্লাহ অপছন্দ করেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘দয়াময় আল্লাহর বান্দা—যারা পৃথিবীতে বিনম্র হয়ে বিচরণ করে। যখন তাদের মূর্খরা সম্বোধন করে তারা বলে সালাম।’ (সুরা ফোরকান, আয়াত : ৬৩)
কথোপকথনে নবী-রাসুলদের শিষ্টাচার
আল্লাহর সঙ্গে কথোপকথনে নবী-রাসুল (আ.) সর্বোচ্চ শিষ্টাচার প্রদর্শন করেছেন। যা সর্বকালের সব মানুষের জন্য অনুসরণীয়। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত নবী-রাসুল (আ.)-এর শিষ্টাচারের কিছু দিক তুলে ধরা হলো।
মহানবী (সা.)-এর শিষ্টাচার : মহানবী (সা.) ছিলেন সর্বোত্তম আদর্শ ও শিষ্টাচারের অধিকারী। পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াতে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চারিত্রিক পবিত্রতা ঘোষণা করা হয়েছে। যেমন তাঁর অন্তঃকরণ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘আমি কি আপনার হৃদয়কে প্রশস্ত করিনি?’ (সুরা আশ-শরাহ, আয়াত : ১)। তাঁর জবান সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘তিনি মনগড়া কথা বলেন না।’ (সুরা নাজম, আয়াত : ৩)। তাঁর সামগ্রিক জীবন সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আপনি সুমহান চরিত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত।’ (সুরা কলাম, আয়াত : ৪)
ইবরাহিম (আ.)-এর শিষ্টাচার : পবিত্র কোরআনে ইবরাহিম (আ.)-এর জবানিতে ইরশাদ হয়েছে, ‘যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন তিনি আমাকে সুপথ দেখান। তিনি আমাকে খাওয়ান ও পান করান। আমি যখন অসুস্থ হই তিনি সুস্থ করেন।’ (সুরা আশ-শুআরা, আয়াত : ৭৮-৮০)
উল্লিখিত আয়াতগুলোয় সব কাজ আল্লাহর সঙ্গে সম্পৃক্ত করলেও তিনি ‘অসুস্থতা’কে নিজের দিকে সম্পৃক্ত করেছেন। কেননা মন্দ কাজ আল্লাহর দিকে সম্পৃক্ত করা শিষ্টাচার বহির্ভূত।
মুসা (আ.)-এর শিষ্টাচার : আল্লাহ বলেন, ‘মুসা যখন তাদের পক্ষে জানোয়ারগুলোকে পানি পান করাল। তারপর সে ছায়ায় নিচে আশ্রয় গ্রহণ করে বলল, ‘হে আমার প্রতিপালক! আপনি আমার প্রতি যে অনুগ্রহ করবেন আমি তার মুখাপেক্ষী।’ (সুরা কাসাস, আয়াত : ২৪)
এখানে মুসা (আ.) নিজের অভাব ও দুরবস্থার জন্য আল্লাহর প্রতি অভিযোগ না করে শিষ্টাচারের সঙ্গে নিজের প্রয়োজন তুলে ধরেছেন। আবার সুনির্দিষ্টভাবে কোনো কিছু চাননি।
ইউসুফ (আ.)-এর শিষ্টাচার : ইউসুফ (আ.) যখন পরিবারের সাক্ষাৎ লাভ করেন, তখন তিনি বলেন—‘আল্লাহ আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন যখন তিনি আমাকে জেল থেকে মুক্ত করেছেন।’ (সুরা ইউসুফ, আয়াত : ১০০)
একটা মিথ্যা অভিযোগে জেল খাটলেও তিনি নিজের অতীত জীবনের দুঃখ-কষ্টের অভিযোগ করেননি; বরং আল্লাহর অনুগ্রহ স্বীকার করেছেন।
আইয়ুব (আ.)-এর শিষ্টাচার : ইরশাদ হয়েছে, ‘আইয়ুব যখন তাঁর প্রতিপালককে আহ্বান করে বলেছিল, আমাকে দুঃখ-কষ্ট স্পর্শ করেছে আর আপনি সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত : ৮৩)
এখানে আইয়ুব (আ.) নিজের দুঃখ-কষ্টের জন্য কোনো অভিযোগ না করে আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ প্রার্থনা করেছেন।
ঈসা (আ.)-এর শিষ্টাচার : পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ যখন বলবেন, হে মারিয়ামের ছেলে ঈসা! তুমি কি লোকদের বলেছিলে তোমরা আল্লাহ ছাড়া আমাকে ও আমার মাকে দুইজন উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করো? সে বলবে, আপনিই পূতপবিত্র! যা বলার অধিকার আমার নেই, তা বলা আমার জন্য শোভন নয়। যদি আমি তা বলতাম, তবে আপনি তা জানতেন। আমার অন্তরের কথা আপনি জানেন, কিন্তু আপনার অন্তরের কথা আমি জানি না; আপনি তো অদৃশ্য সম্পর্কে সম্যক অবগত।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ১১৬)। উল্লিখিত কথোপকথনে ঈসা (আ.) চূড়ান্ত বিনয়ের সঙ্গে নিজের কর্তব্য পালন ও শিষ্টাচার রক্ষার কথা বলেছেন। আল্লাহ সবাইকে কথা ও কাজে শিষ্ট হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।